নওগাঁ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা উঠলেই যে নামটি গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়, তা হলো বলিহার জমিদার বাড়ি। রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ সদর উপজেলার বলিহার ইউনিয়নে অবস্থিত এই জমিদার বাড়িটি কেবল একটি প্রাসাদ বা স্থাপনা নয়—এটি একসময়ের জমিদার শাসন, শিল্প-সংস্কৃতি, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও বিদ্যাচর্চার জীবন্ত সাক্ষী।
উৎপত্তি ও ইতিহাস
বলিহার জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নৃসিংহ চক্রবর্তী। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর শাসনামলে তিনি বলিহার অঞ্চলে জায়গির লাভ করেন। এরপর থেকেই বলিহারে জমিদার শাসনের সূচনা হয়। বলিহার জমিদাররা শুধু জমিদারি কর্তৃত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং এলাকায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, দিঘি-পুকুর খনন, শিক্ষা বিস্তারসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজেও ছিলেন অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী।
রাজ-রাজেশ্বরী মন্দির ও ধর্মীয় ভাবগম্ভীরতা
১৮২৩ সালে জমিদার রাজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নির্মাণ করেন রাজবাড়ির অভ্যন্তরে একটি নয়নাভিরাম মন্দির, যেটির নাম রাজ-রাজেশ্বরী দেবীর মন্দির। সেখানে স্থাপন করা হয়েছিল পিতলের তৈরি রাজেশ্বরী দেবীর একটি মূর্তি, যা সে সময় বলিহারসহ আশপাশের অঞ্চলে পূজা-অর্চনার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এই মন্দির আজও বলিহার রাজবাড়ির অন্যতম আকর্ষণ।
শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চা
বলিহার জমিদারদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও সংস্কৃতিবান। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নাম কৃষ্ণেন্দ্রনাথ রায় বাহাদুর রাজা। তিনি একজন প্রতিভাবান সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর রচিত "কৃষ্ণেন্দ্র গ্রন্থাবলী (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)" বাংলা সাহিত্যের এক মূল্যবান সম্পদ।
দেশভাগ ও জমিদারির বিলুপ্তি
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় বলিহারের রাজা ছিলেন বিমেলেন্দু রায়। দেশভাগের পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে তিনি পরিবারসহ ভারতে চলে যান। তার চলে যাওয়ার পর রাজবাড়ির দেখভালের দায়িত্ব পড়ে স্থানীয় কর্মচারীদের ওপর। দীর্ঘদিন দেখভালের অভাবে রাজবাড়ি হারাতে থাকে তার জৌলুশ ও অতীত গৌরব।
লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ও পরবর্তীকালে বলিহার রাজবাড়ির বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন, আসবাবপত্র, মূল্যবান জানালা-দরজা এবং স্থাপত্যসামগ্রী লুটপাট হয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজবাড়ির অনেক অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অতীতে এক ভবন স্থানীয় স্কুলের শ্রেণিকক্ষ হিসেবে ব্যবহার হলেও এখন তা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তবে রাজবাড়ির অভ্যন্তরে থাকা দেবালয়টি এখনো পূজা অর্চনার কাজে ব্যবহৃত হয়, যা সেই ঐতিহ্যের শেষ নিদর্শন হিসেবে রয়ে গেছে।
জনশ্রুতি ও দীঘি খননের কাহিনি
এক জনপ্রিয় জনশ্রুতি অনুসারে, মুঘল সম্রাট আকবর এর সেনাপতি রাজা মানসিংহ বার ভূঁইয়াদের দমন করতে সেনাবাহিনী নিয়ে বলিহারে আগমন করেন। দীর্ঘপথ অতিক্রম করে ক্লান্ত সেনাদের বিশ্রাম ও কর্মে ব্যস্ত রাখতে এবং গুপ্তচরের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহে তিনি বলিহারে যাত্রাবিরতি করেন। সে সময় বরেন্দ্র অঞ্চল ছিল শুষ্ক, তাই সেনা অলসতা দূর করতে তিনি স্থানীয় জনগণ ও সৈন্যদের মাধ্যমে প্রায় ৩৩০টি দীঘি ও পুকুর খনন করান। এ দীঘিগুলো এখনও এলাকাবাসীর জলসেচ ও পানীয় জলের অন্যতম উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
অবস্থান ও বর্তমান অবস্থা
বলিহার রাজবাড়ি নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার পশ্চিমে, নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের পশ্চিম পাশে বলিহার ইউনিয়নের কুড়মইল মৌজায় অবস্থিত। বর্তমানে প্রাসাদটির মূল কাঠামো অনেকটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও ঐতিহাসিক গুরুত্বে এটি এখনো পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
উপসংহার
বলিহার জমিদার বাড়ি শুধু ইট-পাথরের একটি স্থাপনা নয়, এটি বাংলার জমিদারি প্রথা, ধর্মীয় বিশ্বাস, শিক্ষা-সাহিত্য, এবং দেশভাগের করুণ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণের অভাবে এই রাজবাড়ি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। স্থানীয় প্রশাসন ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উচিত – এই ঐতিহাসিক নিদর্শনকে সংরক্ষণ করে তা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা।
ইতিহাস যদি না টিকে থাকে, তাহলে জাতির শেকড়ও দুর্বল হয়ে পড়ে। বলিহার রাজবাড়ি আমাদের শেকড়, আমাদের আত্মপরিচয়।
0 Comments